বুধবার, ০৬ Jul ২০২২, ০৩:৫৬ পূর্বাহ্ন
দেশী খেজুরের স্বাদ অনন্য হওয়ায় বেড়ে যায় শিশু-কিশোরীদের দূরন্তপনা
দামুড়হুদা অফিস থেকে, তানজীর ফয়সাল: দামুড়হুদা উপজেলার সদর ইউনিয়নসহ বিভিন্ন গ্রামের খেজুর গাছগুলোতে দুলছে কাঁদি ভরা কাঁচাপাকা সুমিষ্ট স্বাদের খেজুর। পাকা খেজুর গাছের নিচে খেজুরপড়ার অপেক্ষায় থাকেন শিশু কিশোররা। একটা পাকা খেজুর গাছের নিচে পড়লে কে কার আগে কুঁড়িয়ে নিয়ে খেতে পারে। প্রাচীনতম ফলের মধ্যে অন্যতম এ দেশী খেজুরের স্বাদ অনন্য হওয়ায় খেজুর পাকলেই বেড়ে যায় কিশোরীদের দুরন্তপনা।
খেজুর গাছ সৌন্দর্যবর্ধক। শহর কিংবা গ্রাম দুই জাগাতেই এ গাছ রোপণের মতো পরিবেশ রয়েছে। শহরে পার্ক কিংবা বড় কোন স্থাপনার সীমানায়, স্কুল-কলেজের পাশে, সড়ক পথের দুই ধারে, গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন ফসলের ক্ষেতের আইলে, রাস্তার পাশে, বাড়ী বা মাঠের কোনায়, এমনকি রেললাইন কিংবা পুকুর পাড়েও খেজুর গাছ রোপন করা যায়। সাধরণত খেজুর গাছ কেউ ইচ্ছে করে রোপন করে না। মানুষ ও পাখ-পাখিরা খেজুর খাওয়ার পর মাটিতেই তার বীজ ফেলে রাখে, আর সেটা থেকেই গাছের জন্ম হয়ে থকে বলে জানা যায়।
দামুড়হুদা উপজেলার নাপিতখালি-বদনপুর, দেউলী, চিৎলা, মোক্তারপুর, হাউলী, কেশবপুর, পারদামুড়হুদা, হোগলডাঙ্গা, লোকনাথপুর ও জুড়ানপুরে ঘুরে দেখা যায়, রাস্তা, বসত বাড়ী, পুকুর পাড়, প্রতিত জমিসহ ফসলী জমির আশপাশে সারিবদ্ধভাবে খেজুর গাছে একপায়ে দৃশ্যমান পত্রদন্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। গাছগুলোতে রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণ কাঁচা-পাকা খেজুর। পথচারীদেরকে মুগ্ধ করছে খেজুর দোলার দৃশ্য। তবে, আগের তুলনায় খেজুর গাছের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। বিশেষ করে পুরুষ খেজুর গাছে রস কম হওয়ার কারণে সেগুলো কেটে ইটের ভাটাতে বিক্রি করা হয়ে থাকেন। এছাড়াও রস মৌসুমের সময় খেজুর গাছ ছাঁটাইকালে অদক্ষতার কারণে রস বেশী পাওয়ার আশায় কাণ্ডের শেষ প্রান্ত চেঁছে গর্ত করে ফেলায় অনেক গাছ অকালে নষ্ট হয়ে যায়। ফলে, আজ গ্রামাঞ্চলে অনেক খেজুর গাছ থেকে পরে আর আশানুরূপ কৃষক রস সংগ্রহ করতে না পারাতে এ গাছ কেটে বিক্রি করে থাকেন।
প্রতি বছর নির্দিষ্ট কিছু দিনে বৃক্ষ-নিধন বন্ধ করুন, গাছ লাগান ও পরিচর্যা করুন’ এমন স্লোগান শোনা যায়। ঘোষণা দিয়ে হয়তো কিছু গাছও রোপণ করা হয়। অতচ কৃষি প্রধান এ দেশে খেজুর গাছও আর্থিকভাবে সম্ভাবনাময় হতে পারে এমনটা আমরা কখনও ভেবে দেখি না। নানান রকম ঔষধী এবং ফলের গাছ রোপণ করা হলেও উপজেলাতে তেমন কোন যত্ন ছাড়াই বেড়ে ওঠা খেজুর গাছগুলো আজও অবহেলিত রয়ে গেছে।
উজিরপুর গ্রামের স্কুল শিক্ষার্থী রিয়াদ এর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ছোট বেলাতে খেজুর গাছের নিচ থেকে পাকা খেজুর কুড়িয়ে খেতাম; খুব মজা লাগতো। এখনো সময় পেলে বন্ধুদের সাথে অনেকেই পাকা খেজুর পড়েছে কি? দেখার জন্য খেজুর গাছের নিচে যেয়ে খুঁজি। পাকা খেজুর না পেলে গাছ থেকে কাঁদি কেটে নিয়ে বাড়ীতে এসে তা লবন আর পানি ছিটিয়ে বস্তার মধ্যে বা ধাণের গোলাতে রাখি। দুই একদিনের মধ্যে খেজুর গুলো পাকলে বাড়ীর সবাই ও বন্ধুদের সাথে নিয়ে একসাথে খেয়ে থাকি।
দামুড়হুদা সদর ইউনিয়নের চিৎলা গ্রামের কৃষক সাইদুর রহমান জানান, উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে চোখ গেলেও দূর থেকে দেখা যেতো প্রচুর খেজুর গাছে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে। এখন আর তেমন একটা দেখা মেলে না। ভাটার সিজন আসলে প্রতিবছরই ইট ভাটার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের ফলে এখন খেজুর গাছ বিলুপ্তর পথে।
একই গ্রামের যুবক কৃষক আক্তার বলেন, উপজেলাতে যেসব খেজুর গাছ আছে, তাতে এ বছরে প্রচুর ফল ধরেছে। যা ইতিমধ্যে পাকতেও শুরু করেছ। ছেলে মেয়েদের জন্য অনেক সময় খেজুরের কাঁদি কেটে এনে বাড়ীতে লবন পানি দিয়ে পাকাতে দেওয়া হয়। তাতে তারা খুব খুশী হয়ে খান। আগের দিনে এ সুমিষ্ট স্বাদের খেজুর গ্রাম থেকে শহরের মোড়ে বসে বিক্রি করতে দেখা গেলেও কালের বিবর্তনে তা হারিয়ে গেছে।
উপজেলার নতিপোতা ইউনিয়নের হেমায়েতপুর গ্রামের বাসীন্দা হাতেম মালের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, খেজুর গাছ শুধু যে ফলই দেন তা কিন্তুু নয়। শীত মৌসুমে খেজুর গাছ থেকে মিষ্টি রস পাওয়া যায়। যা দিয়ে তৈরী করা হয় গুড়। খেজুরের রসও প্রায় সবারই প্রচ্ছন্দ। খেজুরের রস ও গুড়ের তৈরী পিঠা বাঙালীর ঐতিহ্যের অংশ। তাছাড়া এ গাছের পাতা দিয়ে পাটি ও কাঁচা ঘরের বেড়া তৈরীতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
সচেতন মহল বলছেন, খেজুর গাছ চাষে কোন খরচ হয় না। বিস্তৃর্ণ জমির প্রয়োজন পড়ে না। শুধু দরকার সদিচ্ছা। এ ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পুরুষ খেজুর গাছ থেকে রস কম হলেও সে গাছের রসে মিষ্টির পরিমাণ বেশী থাকে। ফলে, পুরুষ গাছ কাটার আগে বুঝতে হবে, পুরুষ গাছ না থাকলে অন্যান্য স্ত্রী গাছের পরাগ সংযোগ ঠিকমতো হয় না। এ কারণে ফলনও কম হয়। এ ছাড়াও রস সংগ্রাহকদের বিজ্ঞানসম্মতভাবে গাছের কাণ্ডের শেষ প্রান্ত ছাটাই কাজে দক্ষ করে তোলা দরকার। তা না হলে গাছের বেশ ক্ষতি হয়। এ বিষয়গুলো চিহ্নিত করে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত যাতে করে খেজুর গাছ রোপণে বৃক্ষচাষীরা উৎসাহিত হন এবং খেজুর চাষ করে তারা লাভবান হতে পারেন। ফলে, ঐতিহ্যবাহী খেজুর রস, গুড় কিংবা খেজুর ফল পেতে হলে প্রতি বছর বৃক্ষরোপণের সময় সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে খেজুর গাছ রোপণের উপর জোর দেওয়া জরুরি।
খেজুরের পুষ্টিগুণ বিষয়ে জানতে চাইলে দামুড়হুদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স-এর মেডিকেল অফিসার সোহরাব হোসেন আমাদের এ প্রতিবেদক কে বলেন, খেজুর আরবদেশের প্রধান ফল। এ খেজুরের একটা জাত আমাদের বাংলাদেশে জন্মে, যার ফল আমরা খাই। ছোট বাচ্ছাদের কাছে এ ফল খুবই প্রিয়, পাশাপাশি বড়দেরও পাচ্ছন্দের। দেশী এ খেজুরের রঙ হলুদ থেকে খয়েরী বর্ণ ধারণ করলে ফল সংগ্রহের উপযুক্ত হয়। ঋতু পরিবর্তনের সময় আমাদেরকে যেসকল রোগ হয় সেগুলো প্রতিরোধে দেশী ফল খাওয়া প্রয়োজন। মৌসুমী ফল মৌসুমী রোগ প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকেন। তাছাড়া দেশী ফলের পুষ্টিও বেশী। সেজন্য দেশী খেজুর খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী হয়ে থাকে।