সোমবার, ০৮ অগাস্ট ২০২২, ০৬:২৯ পূর্বাহ্ন
শুক্র-শনিবার দুই দিনের ছুটি। শহরের জঞ্জাল ছেড়ে এই ছুটি কাটাতে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে এমভি অভিযান-১০-এ বরগুনা রওনা হয়েছিলেন তিন শতাধিক যাত্রী। তবে, এদের মধ্যে অনেকের আর জীবিত বাড়ি ফেরা হয়নি। গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৩টার দিকে লঞ্চটি ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার দপদপিয়া এলাকায় পৌঁছালে ইঞ্জিন কক্ষে আগুন লেগে অনেকের মৃত্যু হয়েছে। (২৪ ডিসেম্বর) শুক্রবার রাত ৮.৩০টা পর্যন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে ৪২ জনের। দুই শতাধিকেরও বেশি যাত্রী দগ্ধ ও আহত হয়েছেন। দগ্ধ ৯৫ জনকে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে অন্তত ৪০ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লঞ্চের ভেতরের চিত্র ভয়াবহ। দেখলে মনে হবে যেন অনেক বছর আগের পরিত্যক্ত একটি লঞ্চ।
ঝালকাঠি ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের স্টেশন অফিসার শহিদুল ইসলাম গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেছেন, এ ঘটনায় ৪২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। লঞ্চে হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ শোকবার্তায় নিহতদের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। তিনি আহতদের আশু আরোগ্য কামনা করেন। মালদ্বীপ সফররত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোকবার্তায় নিহতদের রুহের মাগফিরাত কামনা এবং আহতদের আরোগ্য কামনা করেছেন। তিনি নিহতদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
আগুনে হতাহতের ঘটনায় ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ। গতকাল বিষয়টি নিশ্চিত করে বিআইডব্লিউটিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা মিজানুর রহমান জানান, বন্দর ও পরিবহন বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মো. সাইফুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে এ কমিটি করা হয়েছে। এ ছাড়া পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে ঝালকাঠি জেলা প্রশাসন। ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক জোহর আলী বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, লঞ্চ দুর্ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক নাজমুল আলমকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
এদিকে, লঞ্চের আগুনে নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে দেড় লাখ টাকা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। গতকাল বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দগ্ধ ব্যক্তিদের দেখার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন প্রতিমন্ত্রী। খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এ ঘটনায় নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে যাত্রীকল্যাণ তহবিল থেকে দেড় লাখ করে টাকা দেওয়া হবে। আহতদের চিকিৎসার সব খরচ সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হচ্ছে। যারা মারা গেছেন, জেলা প্রশাসন তাদের দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করবে। সবকিছু জানার পর আমরা বাকী ব্যবস্থা নেব।
আগুন লাগার কারণ সম্পর্কে খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এ বিষয়ে জানতে তদন্ত কমিটি করেছি। প্রতিবেদন না পাওয়া পর্যন্ত বলতে পারব না কীভাবে ঘটনা ঘটেছে। আমি এখানে এসে সরেজমিনে দেখছি। এতে আমারও একটা ধারণা তৈরি হবে। সেই ধারণার সঙ্গে প্রতিবেদন কতটুকু সামঞ্জস্য হয়, প্রতিবেদন পাওয়ার পরই তা বলতে পারব। এমভি অভিযান-১০ লঞ্চটির ফিটনেস ছিল কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা যতটুকু জানি ২০২২ সাল পর্যন্ত লঞ্চটির ফিটনেস ছিল। প্রতিমন্ত্রী ঝালকাঠির নলছিটির সুগন্ধা নদীর পোনাবালীয়া ইউনিয়নের দেউরী এলাকায় লঞ্চ দুর্ঘটনার স্থান পরিদর্শন করেন।
পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা থেকে তিন শতাধিক যাত্রী নিয়ে বরগুনা যাচ্ছিল অভিযান-১০ লঞ্চটি। রাতে ইঞ্জিন কক্ষ থেকে আগুন লাগে। এ সময় কেবিন ও ডেকের বেশিরভাগ যাত্রী ঘুমিয়েছিলেন। লঞ্চটি গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৩টায় নলছিটির দপদপিয়া এলাকায় পৌঁছালে ইঞ্জিন কক্ষে আগুন ধরে যায়। তবে কেবিন বয় ইয়াসিন জানান, লঞ্চে পাঁচ শতাধিক যাত্রী ছিল। ওপরে থাকা বেশিরভাগ যাত্রী নদীতে লাফ দিয়েছেন। ঝালকাঠির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মইনুল হক জানান, ৯৫ জনের বেশি দগ্ধ যাত্রীকে ঝালকাঠি সদর হাসপাতাল ও বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
বেঁচে যাওয়া যাত্রী বামনা উপজেলার মো. আবদুল্লাহ জানান, আগুন দেখে নিচতলার ডেকের যাত্রীরা দোতলায় অবস্থান নেন। লঞ্চের স্টাফরা কেবিনের যাত্রীদের বের হতে নিষেধ করে। আগুন লাগার পরও লঞ্চটি প্রায় ৩০-৪০ মিনিট চালিয়ে প্রথমে ঝালকাঠির বিষখালী-সুগন্ধ্যা-ধানসিড়ি নদীর মোহনায় মোল্লাবাড়ী তোতা শাহর মাজার এলাকায় থামিয়ে দেয়। সেখানে লঞ্চের স্টাফসহ তিনশতাধিক যাত্রী নেমে যেতে সক্ষম হয়।
যাত্রী মো. বাচ্চু মিয়া জানান, বেশীরভাগ যাত্রী ও স্টাফরা মাজার এলাকায় নেমে গেলেও লঞ্চে আটকা পড়ে কেবিন ও ডেকের ঘুমন্ত যাত্রীরা। এখান থেকে লঞ্চটি ভাসতে ভাসতে ঝালকাঠির দিয়াকুল গ্রামে সুগন্ধ্যা নদীর তীরে আটকে যায়। এখানেও বেশ কয়েকজন যাত্রীকে উদ্ধার করে স্থানীয়রা। অনেকে লঞ্চ থেকে লাফিয়ে নদীতে পড়েন। ভোর ৫টার দিকে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ নদীর তীর থেকে যাত্রীদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। লাশ রাখা হয় ঝালকাঠি মিনি পার্কের সামনে। আগুনের খবর শুনে বরগুনা ও এর আশপাশে এলাকা থেকে স্বজনরা ঝালকাঠি লঞ্চঘাট এলাকায় আসেন। এ সময় প্রিয়জনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠে এখানকার পরিবেশ। সুগন্ধা নদীর পাড়েও হতাহতদের খোঁজে ভিড় করেন স্বজনরা। এদের কেউ বা হারিয়েছেন বাবা, কেউ বা মা। আবার কেউ বা হারিয়েছেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে।
হারানো স্বজনের খোঁজে আসা বরগুনার মো. হারুন জানান, তার মেয়ে রিমু বেগম ও নাতি লিমা নিখোঁজ রয়েছে। একই এলাকার স্বজন আল-আমিন বলেন, তার বড় ভাই ইদ্রিস নিখোঁজ। স্বজন ফোরকান বলেন, বোন রিনা ও ভাগ্নি নুসরাতের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক মো. জোহর আলী জানান, উদ্ধার ৩৬ লাশের মধ্যে পাঁচটি শনাক্ত করা হয়েছে। সব লাশের ময়নাতদন্ত করে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে। ঝালকাঠির ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক কামাল উদ্দিন ভূঁইয়া জানান, ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা ৩০ লাশ উদ্ধার করেছে। বাকি লাশ কোস্টগার্ড উদ্ধার করেছে। ফায়ার সার্ভিস ও কোস্ট গার্ডের ডুবুরী দল সুগন্ধ্যা ও বিষখালী নদীতে অভিযান অব্যাহত রেখেছে। দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে উপপরিচালক বলেন, তদন্ত ছাড়া এটি বলা সম্ভব না। তবে লঞ্চের যাত্রীরা বলছেন, ইঞ্জিনরুমে বিকট শব্দের পর পুরো লঞ্চে আগুন ধরে যায়। লঞ্চের আহত যাত্রী রাসেল মিয়া বলেন, আগুন লাগার পর লঞ্চের চালক ইচ্ছা করলে আগেই থামাতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে আগুন লাগার পরও লঞ্চটি চালিয়েছেন। সর্বশেষ লঞ্চের স্টাফরা যাত্রীদের মৃত্যুর মুখে রেখে পালিয়ে যান। সূত্র: প্রতিদিনের সংবাদ