রবিবার, ০৭ মার্চ ২০২১, ০৫:৩১ অপরাহ্ন
বিশেষ প্রতিনিধি:
ছয় ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। আর এই ছয়টি ঋতুর মধ্যে ঋতুরাজ বসন্ত। কোকিলের সুমধুর কন্ঠে মাতাল করতে আবার ঋতুরাজ বসন্ত এসেছে শীতের শেষ প্রান্তে। তাই ফাগুনের ছোয়ায় ফুলে ফুলে রঙ্গিন সাজে সেজেছে পলাশ-শিমুলের গাছ। সেই সাথে আমের মুকুলে মুকুলে ভরে গেছে আম গাছগুলো।
বসন্তের আগমনে প্রকৃতি সেজেছে নতুন সাজে এ সম্পর্কে লিখতে গেলে মনে পড়ে যায়, নানান ছন্দ ও কবিতা তার মধ্যে রয়ে গেছে; ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজি বসন্থ কবি সুভাস মুখোপাধ্যায়ের এই অমর পঙক্তিটি ও ‘নারী হয় লজ্জাতে লাল, ফাল্গুনে লাল শিমুল বন’ নারীর সাথে বসন্তের তুলনা করে বয়োজ্যেষ্ঠদের মুখ থেকে শোনা কবীর ভাষায় এই পঙক্তিটি বাঙ্গালির জীবনে আবার ফিরে এসেছে।
বছর ঘুরে প্রকৃতির তার নানা পরিবর্তন পেরিয়ে আবার সেজেছে নতুন রূপে। বসন্তের আগমনে শীতের রিক্ততা ভুলিয়ে ফাগুনের আগুনে মানুষের মন আর প্রকৃতিতে লেগেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। বসন্তের রঙ্গ ও রূপে নিজেকে সাজাতে প্রকৃতি এখন মেতে উঠেছে। প্রকৃতি ধারণ করছে রূপলাবণ্যে ভরা মনোহর পরিবেশ। ফাল্গুনের আগুনে শীতের তীব্র রুক্ষতা কেটে পাতা ঝড়া বৃক্ষগুলির মাথায় দেখা দিয়েছে সবুজ পাতা, কুলি ও ফুল। প্রকৃতিতে বসন্তের সাজ সাজ রব শীতের জীর্ণতা কাটিয়ে ফুলে ফুলে সজ্জিত প্রকৃতি জানান দিচ্ছে বসন্তের আগমনী বার্তা।
চুয়াডাঙ্গা জেলার আমের মুকুলের ঘ্রাণ জানান দিচ্ছে ঋতুরাজ বসন্তের উপস্থিতি। রঙ্গিন ফুলের সমারোহে বর্ণিল সাজে সেজেছে যেমন প্রকৃতি চারপাশ, তেমনি মুকুলে মুকুলে নতুনভাবে সেজেছে চুয়াডাঙ্গা জেলা উপজেলার বিভিন্ন আমের বাগান। মুকুলের ভারে নুয়েপড়ার উপক্রম চারপাশের প্রায় প্রতিটি আমগাছ। আর শোভা ছড়াচ্ছে স্বমহিমায়। মৌমাছিরাও ব্যস্থ মধু আহরণে।
গ্রামবাংলার প্রকৃতিতে রঙিন করতে চুয়াডাঙ্গা জেলা উপজেলায় ফুটছে শিমুল ফুল। তবে শিমুলের লাল রক্তিম ধাঁধানো লাল গাড় ফুল আর আগের মতো চোখে পড়ে না বললেই চলে। গত এক যুগ আগেও জেলার বিভিন্ন উপজেলার গ্রামের অধিকাংশ বাড়ী বা রাস্তার ধারে ধারে প্রচুর পরিমাণের শিমুল গাছ দেখা যেতো। গাছের প্রতিটি ফুল স্বরণ করিয়ে দিতেন এই বুঝি এসেছে বসন্ত। শিমুল অন্যান্য গাছের তুলনায় বেশ উঁচু হয়ে থাকেন, যা বহু দূর থেকে দেখতে দৃষ্টি নন্দিত দেখা যায়। শিমুল শুধু দেখতে সৌন্দর্য বা দৃষ্টি নন্দিতই নয় এর রয়েছে নানা ঔষধির গুনগুন ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব।
জেলার বাগান মালিক ও আমচাষীরা ব্যস্থ সময় পার করছেন পরিচর্ষা নিয়ে। অবশ্য গাছে মুকুল আসার আগে থেকেই তারা গাছের পরিচর্ষা করে থাকে, যাতে গাছে মুকুল বা গুটি বাঁধার সময় কোন সমস্যা না হয়। বাগানে সারিবদ্ধ মুকুলে নুয়ে পড়া আম গাছ গুলো দেখতে যেন অপরুপ সৌন্দর্য। এ উপজেলায় ফজলি, রুপালী, হিম সাগর, মল্লিকা, বিশ^নাথ ও ল্যাংড়াসহ ক’এক জাতের আমের চাষ করা হয়।
আম চাষিরা নিজ উদ্যোগে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এ চারা সংগ্রহ করে আমের বাগান তৈরী করেন বা আম চাষ শুরু করেন। কিন্তু বর্তমানে তারা নিজেরাই চারা উৎপাদন করছেন এবং বাজারজাত করে অর্থ উপার্জনও করছেন উপজেলার আম চাষিরা বা বাগান মালিকেরা।
জানা যায়, প্রাকৃতিকভাবে তুলা আহরণের অন্যতম অবলম্বন শিমুল গাছ। এর তুলা বেশ মূল্যবান। এ গাছের সব অংশেরই রয়েছে ভেষজগুণ। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকরা এখনো নানা রোগের চিকিৎসায় এ গাছের বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করে থাকেন। শিমুল গাছের বৈজ্ঞানিক নাম ‘বোমবাক্স সাইবা লিন’। এটি বোমবাকাসিয়াক পরিবারের উদ্ভিদ। বীজ ও কাণ্ডের মাধ্যমে এর বংশবিস্তার হয়। রোপণের ৫-৬ বছরের মধ্যে শিমুল গাছে ফুল ফোটে। প্রায় ৯০ থেকে ১০০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। সেই তুলনায় বেশ মোটাও হয় । নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে শিমুল গাছ দেড়শ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে।শিমুলের পাতা বছরে শীতের শেষে পাতা ঝরে পড়ে এবং বসন্তের শুরুতেই গাছে ফুল ফোটে। আর এ ফুল থেকেই হয় ফল, যা চৈত্র মাসের শেষের দিকে ফল পুষ্ট হয়। বৈশাখ মাসের দিকে ফলগুলো পেকে শুকিয়ে গিয়ে বাতাসে আপনা আপনিই ফল ফেটে প্রাকৃতিকভাবে তুলার সঙ্গে উড়ে উড়ে দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়া বীজ থেকেই এর জন্ম হয় শিমুল গাছের জন্ম। অন্যান্য গাছের মত এ গাছ কেউ শখ করে লাগায় না, করা হয়না কোনো যত্ন। অনেকটাই অযত্ন আর অনাদরে প্রাকৃতিকভাবেই গাছ বেড়ে ওঠে। এ গাছের প্রায় সব অংশই কাজে লাগে। এর ছাল, পাতা ও ফুল গবাদিপশুর অতন্ত্য প্রিয় খাবার।
লেপ- তোষক তৈরীর কাজে শিমুল তুলার জুড়ি মেলা ভারী দায়। অপ্রিয় হলেও সত্য বর্তমানে ডিজিটাল যুগের মানুষ এ গাছকে তুচ্ছ মনে করে কারণে অকারণে কেটে ফেলেন। অতীতে নির্বিচারে ব্যাপকহারে নির্মাণ কাজ ও ইটভাটার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হয়েছে অতচ সেই তুলনায় রোপণ করা হয়নি এ মূল্যবান গাছটি। ফলে আজ বিলুপ্তির পথে।শিমুল গাছ উজাড় হওয়ার ফলে পরিবেশের উপরে পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। এ গাছ অনেক উঁচু হওয়ায় কাক, কোকিল, চিল, বকসহ বিভিন্ন ধরণের পাখি তাদের আপন ঠিকানা তৈরী করে বসবাস করত। এ গাছ উজাড় হওয়ার ফলে এসব পাখিরা আবাসস্থল হারিয়ে পড়ে প্রায় অস্তিত্ব সংকটে। গাছ না থাকায় আবাসস্থলের অভাবে ধীরে ধীরে এসব পাখিরাও হারিয়ে যাচ্ছেন।
উপজেলার সচেতন মহল বলছেন, ‘আগে গ্রামে প্রচুর শিমুল গাছ চোখে পড়তো। এই শিমুল ঔষধী গাছ হিসেবেও পরিচিত। গ্রামাঞ্চলের মানুষ বিষফোঁড়া ও কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময়ে এ গাছের মূলের অবাধ ব্যবহার ছিল।’
দামুড়হুদা প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, প্রবীণ সাংবাদিক দীন মোহাম্মদ বলেন- এখন আর শিমুল ফুল বা গাছ আগের মতো চোখে পড়েন না। বসন্তবরণ পালনসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শিমুলের ফুলের ছিলেন অবাধ ব্যবহার। তিনি আরো বলেন, শিমুল গাছ রক্ষাসহ রোপণে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। আগামীতে উপকারী গাছের তালিকা থেকে শিমুল গাছটি হারিয়ে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো জানতেও পারবে না হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু’ র সপ্নের সোনার বাংলাদেশর মাটিতে শিমুল নামের একটি মূল্যবান গাছ ছিল।
© All rights reserved © 2020 DailyAmaderChuadanga.com
www.